মানবজমিন’ শব্দটা শুনলেই মনে পড়ে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের “এই” শব্দটিকে চিরজীবী করে দেওয়া গানটি এবং সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “এই” নামে বাংলা ভাষায় অন্যতম সেরা একটি উপন্যাস। শব্দটি ভাঙলে হয় মানব রূপ জমিন। মানব অর্থাৎ লিঙ্গভেদ নির্বিশেষে সকল মানুষ।
তবে এখানে কবি শ্রীজাতর প্রথম ছবি মানব জমিনের গল্পটা মূলত জীবনে মার খাওয়া হেরে যাওয়া নিম্নশ্ৰেণীর মানুষের ঘরের মেয়েদের পড়াশোনা শিখিয়ে সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলার যোগ্যতা অর্জনের এবং শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে উজ্জীবিত করার জন্য একটি বিদ্যালয় গড়াকে কেন্দ্র করে।
এখানে মূল চরিত্র কুহু ও সংকেতের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন প্রিয়াঙ্কা সরকার এবং পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ছবিতে দেখানো হয়েছে তারা দুজন ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ, সংকেত ব্যাঙ্কে কর্মরত এবং কুহু স্কুলে পড়ায় এবং একটি এনজিও চালায় যার নাম ‘মানবজমিন’। তারা দুজনেই মনেপ্রাণে চায় গ্রামের গরিব অসহায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য যে ‘দাতব্য’ স্কুলটি তারা খুলতে চাইছে সেটি যেন সফল হয়।
ওদিকে ধনী ব্যবসায়ী বীরেন্দ্র কুমার চট্টোপাধ্যায় যিনি আবার সম্পর্কে সংকেতের জ্যোঠু, তিনি পারলোকে স্বর্গ লাভ করার আশায় রোজ কিছু না কিছু পুণ্য সঞ্চয়ের চেষ্টা করে থাকেন এবং খাতায় তার হিসাবও রাখেন। এই জ্যোঠুর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
এঁরাই হলেন কাহিনীর প্রধান চরিত্র।
স্কুলটা বাঁচানোর জন্য চাই ৭৫ লাখ টাকা। কুহু অনেক আশায় তাঁর কাছে গিয়েছিল অর্থ সাহায্য পেতে কিন্তু তার আবেদন নাকচ হয়ে যায়। অথচ বীরেনবাবু পাপ- পুণ্য, স্বর্গ -নরক পরলোক নিয়ে এত বেশি মাতামাতি করতেন যে লক্ষ লক্ষ টাকা ধর্ম ও ধৰ্মীয় স্থান ভ্রমনে খরচ করতে রাজি এমনকি তাঁর এই অন্ধ বিশ্বাসের কারণে দুই স্বর্গের জমি কেনাবেচার দালালের ফাঁদে পড়ে স্বর্গে জমি কেনার জন্যও অ্যাডভান্স ৭৫ লক্ষ টাকা দিতে রাজি হয়ে যান। এই নিয়ে জ্যোঠু ভাইপোর বচসা হয় এবং এরপর ছবি মোড় নেয় ক্লাইম্যাক্সের দিকে।
স্বর্গের জমি বিক্রেতার একজন গুণী শিল্পী খরাজ মুখার্জির নানা গুনের মধ্যে একটি প্ল্যানচেটের দৃশ্যে ছবি বিশ্বাসের গলায় মিমিক্রি খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসাধারণ কমিক টাইমিং তো আছেই।
ছবির শুরুতেই দেখানো হয়েছিলো এই জমিতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেলনা,বই, খাতা, বিয়ের পটাসি, বঁটি, কাটা মাছ ইত্যাদি।আর দেখানো হয়েছিলো একটা টিনের দরজা। ব্যাকগ্রাউন্ডে কথা ভেসে আসছিলো মানুষ হাজার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু দরজা একটাই আর সে দরজা বন্ধ থাকে। যদি একবার সে দরজা খুলে যায় তবে স্বপ্ন বাস্তব রূপ নেয়।
পুরো ছবিতে পরকালের স্বর্গ নরকের কথা না ভেবে ইহকালেই পাপ পুণ্য ভাগ করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে,অসহায় মানুষের পাশে থাকার বার্তাই দেওয়া হয়েছে।
যেহেতু কবি শ্রীজাতর ছবি তাই কবিতা থাকবে না তাতো হতে পারেনা। কুহুর ডাইরিতে লুকিয়ে কবিতা লেখা এবং তা ব্যাকগ্রাউন্ডে মাঝে মধ্যে ভেসে আসা বেশ লেগেছে। ব্রেকগ্রাউন্ড মিউজিকও ছিলো অসাধারণ। অল্প কটি গানও ছিলো শ্রুতিমধুর। এ ছবির সংগীত পরিচালক জয় সরকার।
কাহিনীটিতে মূল্যবোধ ও কিছুটা নতুনত্ব থাকলেও বেশ কিছু অসংগতিও রয়েছে। যেমন ছবিতে দেখানো হয় ভাইপো জ্যোঠুর সাথে এক বাড়িতে থাকেনা কিন্তু তার কারণ কোথাও স্পষ্ট নয়। আর বীরেনবাবু একজন অত্যন্ত হিসাবি,বিচক্ষণ সফল ব্যবসায়ী হয়েও অতগুলো টাকা পারলোকে জমি কেনার জন্য দুজন অচেনা মানুষকে কী করে দিতে রাজি হয়ে গেলেন সেটাও কিছুটা হলেও প্রশ্ন চিহ্নর সামনে দাঁড় করায়।এছাড়াও ছবিতে আর একটা জায়গায় বেশ দুর্বলতা ধরা পড়ল। যেখানে, প্রতারকরা টাকা নিয়ে প্রতারিত বৃদ্ধের বাড়ি থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বেই দিবালোকে চেক হস্তান্তরিত করার কাজটা করলেন এবং তাদের চারজনকে বৃদ্ধ দেখে ফেললেও তারা কেউ একজনও বৃদ্ধকে দেখতে পেলেন না। তাছাড়াও প্রতারকদের কাজকর্ম গুলো ক্রমশ পূর্বানুমানযোগ্য হয়ে পড়েছিলো, সেই কারণে তেমন চমকও লাগেনি। একজায়গায় লেডি ডাক্তারের বলা শ্রীমদ্ভাগবত গীতার শ্লোকের উচ্চারণও অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ।
এসমস্ত ত্রুটিবিচ্যুতি গুলিকে খেয়াল রেখে যদি ছবিটি বানানো যেতো তবে বোধহয় ছবিটা পরিপূর্নভাবে উপভোগ্য হতে পারত।
তিতাস